একজন গোরখোদকের গল্প
সন্ধ্যায় আমি বইসা ঝিমাইতে ছিলাম। হঠাত কইরা শুকনা পাতার উপরে কার জানি হাটার আওয়াজ পাইলাম, তখনও জানতাম না, আজ রাতে এই রকম কিছু একটা হবে।
মানুষ হাটার শব্দ তো মনে হচ্ছে না।মানুষের হাটার আওয়াজ এমন না।তাহলে কি?বুকটা ধক করে উঠল।
কে ? কে হাটে?
ঝুপরি ঘরের ভেতর থাইক্যাই কইলাম।আওয়াজ বন্ধ হইয়া গেল।
মেলাক্ষণ পরে হাসির শব্দ।
হিঃ হিঃ হিঃ।
!
বুকের ধকধকানি বেড়ে গেল,্কেউ জানি বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাইছে।্রক্ত হিম করা হাসি আবার শুনা গেল।এত কোনো মানুষের হাসি না।তবে কে হাসে…
আয়াতুল কুরছি পড়তে পড়তেবাইরে এলাম।টরচটা ধরতেই জ্বল জ্বল দুটি আলো চোখে পড়ল।
!
!
!
-“ধুর,শালা ।এটা তো দেহি খাটাস।তাইতো কই?মানুষের হাসি তো এত ভয়ঙ্ক্রর না।“
টরচের আলো ধরে হুস হুস শব্দ করে একটা দাপকি দিলাম।লেজ গুটাইয়া পালাইলো।
-“শালাডা কি কবর খুড়লো নাকি?
কবরটার কাছে গেলাম।দেহি,মেলাডা খুরছে।পুরান কবর।কংকাল,হাড্ডি-গুড্ডি দেহা যাইতাছে।খাটাইস্যার বাচচা কাম বাড়াইয়া দিল।কবরটা আবার মাটি দিয়া ভালামতো ভরাট করা লাগব।কোদাল আইনা কাম শুরু কইরা দিলাম।
হাড্ডি গুড্ডি দেইখা কইলাম, “হায়রে মানুষ!দুনিয়ায় থাকতে তুই কত দাপট দেহাছ।মাইর-ধুইর,লোক ঠকানি,জোচচরি-বাটপারি,অন্যায়-
আফছারীর বাপেও অহংকার কিচিমের মানুষ।গরিব বইলা আফসারীরে আমার কাছে দিবার চাইল না।কিন্তু হেরে আমি কোনো দোষ দেই না ।মা-মরা মাইয়্যা।বাপে মাইন্য-গন্য মাস্টার।মাইয়্যারে বড় ঘরে বিয়া দিব এডা চাউনই স্বাভাবিক।কিন্তু মাইয়্যা যে আমারে পছন্দ করে আর আমিও।তাইতো পালাইয়া শহরে আইয়া বিয়া করা লাগলো আমাগো।
শহরে এক চাচার বাড়িতে উঠলাম।বাপজানের বন্ধু।বাপজান যহন বাইঁচা আছিল তহন বাপজানের লগে ঢাহা শহরে আইছিলাম।তহন পরিচয়।চাচা আমাগো থাহনের ব্যবস্থা করল আর আমার একটা কামেরও ব্যবস্থা করল।বিল্ডিংএর কাম।
মাডি দেয়ন শেষ কইরা ওযু করলাম।এশার নমাজের সময় হইছে।নমাজ পইড়া , আফসারীর গোরের কাছে আইয়া বইলাম।কান পাতলাম গোরের উপর।
_আফসারী।তুমি ঘুমাইছো?ঘুমাও,শান্তিতে ঘুমাও ।বাইচা থাকতে তো তুমারে খুব এ কটা সুখ দিবার পাইলাম না।দারিদ্রতা নসিবে নিয়া জন্মাইছিলাম যদিও তুমি কোনোদিন অভিযোগ কর নাই।
দিন-আনি,দিন খাই।আফসারীরে ব্যার পর কিছু দেওন হয় নাই।ভাবলাম আফসারীরে একটা নীল সারি দিমু।নীল শাড়িতে ওরে হুব মানাইবো।
একদিন একটা বাড়তি কাম পাইলাম।একটু বেশি আয় হইলো।শাড়ির দোকানে চইলা গেলাম।
সন্ধায় বাড়ির কাছে আইতেই আফসারী দরজা খুইলা দিল।যেন হে আগে থাইক্যাই জানত।তীব্র ভালোবাসা কি এমনি হয়!আগে থেকে মনরে সজাগ কইরা দেয়!
তবে আজ দেরি হইছে দেইখা তার মন ভার।
আমি কইলাম,”আমার আফসারীর মন ভার নাহি?”
আফসারী কইল,” হ।আফনে আজ অত দেরি কইরা আইলান ক্যান?আফনে জানেন,আমি কত টেনশানে ছিলাম?”
আমি হাসি হসি মুখ করে কৌতুক করে কইলাম, “ওরে আমার আফসারী,আমি ভীষণ সরি,
শাড়ি দেইখা আফসারী মহাখুশি।মূহূর্তেই আফসারীর মুখ পূর্ণিমার লাগান উজ্জ্বল হইয়া গেল।হাসলে যে তারে কত সুন্দর লাগে হে কি তা জানে?
আফসারী কইল,”কত সুন্দর!!তুমি এহানে বও।আমি এহনি শাড়িডা পইরা আইতাছি।“
আফসারী শাড়ি পইরা আমার সামনে আইসা , হাসি হাসি মুখ কইরা খাড়াইইয়া আছে।আমি পুরা হা হইয়া গেলাম।আমি যেরম ভাবছিলাম তার চাইয়াও অনেক সুন্দর লাগতাছে।আমার মনে হইল বেহেশতের হুর আমার সামনে আইসা খাড়াইয়া আছে।মুগ্ধ নয়নে আমি চাইয়া আছি হেই স্বর্গীয় অপ্সরার দিকে।
আফসারী হাসতে হাসতে কইলো,”আফনে ওরম হা কইরা ক্যান।মুখে মশা-মাছি ঢুকবো।হাঃ হাঃহাঃ…।আইচ্ছা,কইন তো কেমন লাগতাছে আমারে? “
মাইয়্যা মাইনষের এই হইলো সমস্যা।জানে,নিজেরে সুন্দর লাগতাছে তাও এডা অন্যের মুখে না শুনলে ভাল্লাগে না।কিন্তু এই সমস্যাডা আবার আমার ভালা লাগে।
আমি কইলাম, “বেহেশতনে আইলো জানি সুন্দরী এক হুর,
হাতটা তাহার ধরতে পারলে যামু বহুদূর”।
আফসারী খিলখিলিয়ে হাইসা কইলো,”আফনে দেহি কবি হইয়া গেছেন।নেন, হাত ধরেন।“
আমি হাতটা ধরলাম।
আফসারী কইলো ,”আমারে খুব ভালোবাসেন ,তাই না?”
-খুউউউউউউব।
-আমিও আফনেরে খুব ভালোবাসি।
সে রাতে আমরা হার ধরে অনেকক্ষণ হাঁটলাম।
আরেকদিনের ঘটনা।ওই দিন আফসারীর মনডা খারাপ।
কইলাম,”বাড়ির কথা মনে হইতাছে?”
আফসারী কইলো,”হ।আরেকটা কারণ আছে?”
-কি?
আফসারী কইলো,” পাশের বাড়ির বাড়ি আইছিল।খুব ধার্মিক মহিলা।হে আমারে কইলো প্রেম করা,পালাইয়া বিয়া করন নাহি আমাগো ধর্মে হারাম।বিরাট গুনাহ হয়।আল্লাহ পাক এডা একদম পছন্দ করেন না।হে,আমারে বাড়িত যাইয়া বাপের কাছে ফাফ চাইবার কইলো।আর আল্লাহর কাছেও কান্দাকাটি কইরা মাফ চাইবার কইলো।তাওবা করবার কইলো।তাইলে আল্লাহ পাক মাফ করবার পারেন।“
আমি কইলাম,” তাহলে কি কও?সামনের হপ্তায় আমার ২ দিনের কাম বন্ধ।চলো তাইলে গ্রামে গিয়া তুমার বাপের পা ধইরা মাফ চাই।“
ওইদিন শেষ রাইতে আমরা দুইজনের আল্লাহর কাছে কান্দাকাটি করছি।মাফ চাইছি।
গ্রামে আইলাম।
আফসারীর বাপ আমাগো দেইখা মুখ ফিরাইয়া নিল।দুইজনেই হুড়মুড় করে পায়ে পইরা গেলাম।
মা-মরা মাইয়্যার কান্দন দেইখা বাপের পাথর দিল গইলা গেল।আমাগো মাফ কইরা দিলো।
আমরা ২ দিন গ্রামে থাকলাম।আহনের দিন,
আফসারীর বাপ আমারে কইলো, “তা জামাই বাবাজি,তুমি কি আমার মাইয়্যারে ঠিকমতো খাওয়াও ,পরাও??”
কথার মাঝে একটা তুচ্ছ-তাছিল্যের ভাব ছিল। স্বামীর মান রাখতে আফসারী আগাইয়া আইলো।
আফসারী কইলো,”ও শহরে কাম করে,আব্বা।আর আমারে খুব ভালোবাসে।“
-“শুধু ভালোবাসা দিয়া জীবন চলে নারে ,মা।তুই আমার কাছেই থাক।“
আফসারী কইলো,”না,আব্বা।আমরা খুব ভাল আছি।আপনি আমাগো লাইগ্যা দুয়া কইরেন।“
শহরে ফিরা আইলাম।কাম-কাজ কইরা দিন মোটামুটি ভালোই যাইতাছিল।একদিন হুনি,দেশে নাহি করোনা আইছে।রোগডা নাহি খুব ভয়ানক।মেলা মানুষ মরতাছে।
সরকার সারা দেশে লকডাউন দিয়া দিলো।সব কাম-কাজ বন্ধ হইয়া গেলো।বিল্ডিং এর কামও বন্ধ হইয়া গেলো।ঘর তইন জরুরি দরকার ছাইড়া বাইর হউন যাইব না।
কয়েকদিন পর অভাব আমাগো তার ভয়ংকর চেহারাখান দেহাইলো।ঘরের চাল-ডাল প্রায় শেষ।অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাইতে লাগলাম।আফসারীরে হের বাপ নিবার আইছিল কয়দিন আগে।তা হে গেল না।গেলেই বোধ হয় তার ভাল হইতো।
আমি কামের খুঁজে বাইর হইলাম।নাহ।কোথাও কোনো কাম নাই।সরকার নাহি জরিমানা করতাছে।এই ভয়ে আরো সব বন্ধ।হুনছিলাম সরকার নাহি ত্রাণ-টাণ দেয়।কই?আমরা তো কিছু পাই না!!
ঘরে আইয়া দেহি আফসারী নিচে পরা।
-হায়!হায়!কি হইলো তুমার!
তাড়াতাড়ি কাছে গেলাম।কোলে কইরা নিয়া খাটে শোয়াইলাম।
-জ্বরে দেহি গা পুড়া যাইতাছে!
কয়দিন ধইরাই তার শ্বাস কষ্ট হইতাছিল।লক্ষণ ভালা না দেখা হেরে নিয়া হাসপাতালে গেছিলাম।তা হেরা কয় – এই কর সেই কর ,এই টেস্ট সেই টেস্ট করে খালি।এসবে আবার মেলা খরচ।এইদিকে আমার হাত প্রায় খালি।
আফসারি কইলো ,” আফনি অত টেনশন কইরেন না।এমনেই ভাল হইয়া যামু।“
এমনেই এমনেই আবার কিভাবে ভালা হয়!!আমি ফার্মিসি তন ঔষধ কিনা দিলাম।তাই খাইতাছিল।
জলপট্টি দিতে দিতে কইলাম,”আফসারী,আফসারী।বেশি কষ্ট হইতাছে তাই না?”
আফসারী চোখ খুলল।কইলো,আফনে আমারে খুব ভালোবাসেন ,তাই না?
তার শ্বাস জোরে জোরে পরতাছে।কথা কইতে কষ্ট হইতাছে বুঝতাছি।ওর কষ্ট দেখা আর আমার এই চরম দূরাবস্থার কথা ভাইবা চোখে পানি আইসা গেলো।
কইলাম,হ,আফসারী।তুমি ওহন কথা কইয়ো না।তুমার কষ্ট হইতাছে।আমি ডাক্তার লইয়া আইতাছি।
-ডাক্তার আইবো না।আমার করোনা হইছে।আর আফনের কাছে তো টেহাও নাই ত!!
চরম বাস্তবতার কথা মনে করাইয়া দিলো,আফসারী।সত্যই, আমি একবারে রিক্ত হস্ত।তাও
কইলাম,”আমি ব্যাবস্থা করতাছি।ডাক্তার আনমু।তুমার চিকিতসা করামু।তুমি ভালা হইয়া যাইবা।‘’
-‘’আফনে আমারে ছাইড়া যাইয়েন না।হামার হাত শক্ত কইরা ধইরা রাখইন।মনে কইতাছে আমি আর বাচুঁম না।আফনে আমার হাত ছাইরেন না। ‘’
আমি আর চোখে পানি আটকে রাখতে পারলাম না।গাল বেয়ে অঝরে অশ্রু ঝরছে আমার।হাত শক্ত করে ধরে আছি আমি।
কইলাম,”আইচ্ছা,আমি তুমারে ছাইড়া আমি কোথাও যাইতাম না।আর তুমি এরম কথা কইয়া না।“
সে উঠতে চাইল।আমি তারে হেলান দিয়া বসাইয়া দিলাম।তার শ্বাস ক্রমেই জানি বাড়তাছে।
-আফনে আমারে একটু জড়াইয়া ধরবেন?
আমি তারে জড়াইয়া ধরলাম আর কাদঁতে লাগলাম।
…অনেক্ষণ হয়ে গেল।আফসারী কোনো কথা কইতাছে না।তার নিঃশ্বাসের শব্দও পাইতাছি না।তার নিথর দেহ নিস্তব্দ হয়ে পরে রইল আমার বুকের উপর।
বুকটা ধক কইরে উঠল।একটা আকাশ ভেঙ্গে গেল যেন আমার উপর।বুকের ভেতর যেন জ্বলোচ্ছাস আছড়ে পরল যেন।না।নিঃসংগতার দুর্বিষহ হাহাকার আমারে একেবারে ঘিরা ধরলো ।আমি নিজেরে আর সামলাতে পারলাম না।গগনবিদা্রী এক চিতকার দিলাম।
-আফসারী,ও আমার আফসারী…।তুমি আমারে ছাইড়া গেলা…আমি তুমারে ছাইড়া যাইতাম না।
কবরের মাটি কান্নায় ভিইজা গেল।আফসারী মারা গেছে আজ দেড় বছর হইয়া গেছে।তার হাসি এখনো কানে বাজে।আর কান্নায় কপোল ভিজে আসে তার সেই অন্তিম মূহূর্তের কষ্টের কথা মনে করে।
-কবরে হাত রাইখা কইলাম,”আফসারী দেখছ আমি অহনো তুমারে ছাড়বার পারি নাই।“
(দীর্ঘশ্বাস আর নিঃসংগ বিষন্ন নিরবতা…..)
লেখক,
শাফেয়ী শ্রাবন