হীমশীতল বাক্স – ছোট গল্প

হীমশীতল বাক্স

জামাল সাহেব সদ্য চাকরি পেয়েছেন। চাকরি পাওয়ার পর বিয়েও করেছেন নিজের প্রেমিকাকে। সরকারি চাকরি। প্রথম দিকেই  জামাল সাহেবকে পোস্টিং দেয়া হলো তার নিজ জেলা শহর দিনাজপুরে। দিনাজপুরে দশ মাইলের একটু আগে তার অফিস।  বউকে নিয়ে বাসা নিয়েছেন দিনাজপুর শহরে। কারণ তার পৈতৃক বাসা আমবাড়িতে যেটি শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে।  এদিকে ওনার বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরেই ওনার অফিস। প্রতিদিন বাসে যাওয়া আসা করতে হয়। নতুন সংসার তাদের। তিন রুমের বেশ বড় একটি বাসাই ভাড়া নিয়েছেন বউ, জামাল সাহেবের মা আর উনি থাকবেন বলে। জামাল সাহেবের বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। ছোটোবেলা থেকে জামাল সাহেবের মা অনেক কষ্ট করে জামাল সাহেব ও তার ছোট বোনকে মানুষ করেছেন। জামাল সাহেবের ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে ১ বছর আগেই। সে বগুড়ায় তার শশুর বাড়িতে থাকে।

 

ছোটোবেলা থেকে অনেক কষ্ট করে অনেক চড়াই -উৎরাই, আর্থিক সমস্যা মোকাবেলা করে আজ এ পর্যন্ত এসেছে জামাল সাহেব। তার এখন অনেক সুখ। নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ে করেছেন। বোনের ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে। তিনি একটি সরকারি চাকরি পেয়েছেন বেশ ভালো বেতনের।  সব মিলিয়ে চাঁদের হাট এখন। নতুন সংসার সাজানোর জন্য বউ ও জামাল সাহেব মিলে প্রতিদিনি মার্কেটে যান। জামাল সাহেবের বউ এর নাম মিতু। মিতু ও জামাল সাহেব মিলে সংসারের জন্য যা যা প্রয়োজন, খাট পালঙ্ক, হাড়ি পাতিল যাবতীয় সব কিছুই প্রায় কিনে ফেলেছেন। শুধু বাকি ছিল একটা ফ্রিজ কেনা। তো নতুন ফ্রিজ কিনতে যাবেন, এসময় তার এক বন্ধু এসে বলল সে  একটি নতুন ফ্রিজ কিনেছিল ২ সপ্তাহ আগে কিন্তু সে এখন বিদেশে চলে যাবে। তাই ফ্রিজটি সে জামাল সাহেবকে দিয়ে দিতে চায় নামমাত্র মূল্যে। তো বন্ধুর কাছ থেকেই শেষ পর্যন্ত ফ্রিজটি নিল জামাল সাহেব।

 

জামাল সাহেব ফ্রিজটি খুশি মনেই বাড়ি নিয়ে এলেন। কিন্তু জামাল সাহেব জানতেন না যে এরপর কি হতে চলেছে। একদিন রাতে মিতুর অনেক পানি তেষ্টা পায়। গরম কাল ছিল। ফ্রিজের ভেতর থেকে পানি বার করতে যায় সে। কিন্তু এরপর যা হলো তা মিতু কোনোদিনিই ভুলতে পারবে না। ফ্রিজের দরজা খোলার সাথে সাথেই সে দেখতে পেল একটি ছোট মেয়ে ফ্রিজের ভেতর গুটিসুটি হয়ে বসে ঠান্ডায় কাঁপছে। মেয়েটি মিতুর দিকে মাথা তুলে তাকাল। মিতু দেখল মেয়েটির চোখের মধ্যে মনি নেই। পুরো চোখটিই সাদা। সাদা চোখ থেকে রক্ত ঝরছে। মেয়েটির গা থেকে পচা লাশের বিকট গন্ধ বের হচ্ছে।  এটি দেখে মিতু বিকট চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে যায় জামাল সাহেব ও তার মায়ের। তারা দৌড়ে আসে ফ্রিজের কাছে। দেখে মিতু অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি করে চোখে পানির ঝাপটা দেয় মিতুর। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে মিতু সবটা খুলে বলে। কিন্তু তা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না জামাল সাহেব ও তার মায়ের। কারণ তারা গিয়ে ফ্রিজে পানির বোতলই দেখতে পায়। তাছাড়া মিতু অনেক ভৌতিক সিরিয়াল দেখে টিভিতে আর সে ঘুমের ঘোরে ছিল। তাই হইতো সবটা তার চোখের ভুল বা কল্পনা এমনটিই ভেবে নেয় জামাল সাহেব। কিন্তু মিতুর অনেক জ্বর আসে। পরদিন জামাল সাহেব অফিসে গেলেও তাড়াতাড়ি চলে আসে মিতুর সেবা করার জন্য। ২ দিনের মধ্যে মিতু সুস্থ হয়ে ওঠে পুরোপুরি। কিন্তু মিতু এই ঘটনাটি তার মনের কল্পনা বলে মানতে নারাজ। সে অনেক আগে থেকেই ভৌতিক সিরিয়াল দেখে। কই আগে তো এমন হয় নি! যাই হোক ঘটনা এখানেই শেষ হয় না। কিছুদিন পর জামাল সাহেব রাতে ঘুম থেকে উঠেন বাথরুমে যাওয়ার জন্য। যখন তিনি ফ্লোরে পা দেন, তখন ফ্লোরে উষ্ণ তরলের মতো কিছুর স্পর্শ অনুভব করেন।  লাইট জ্বালিয়ে দেখেন তার রুমের পুরো ফ্লোর জুড়ে লাল রক্তের বন্যা। বিছানার ওপর তাকিয়ে দেখেন মিতু নেই। দৌড় দিয়ে তার রুম থেকে বার হয়ে ডায়নিং রুমে যান যেখানে ফ্রিজটি রাখা। ডায়নিং রুমের লাইটটি জ্বলছে আর নিভছে। তিনি দেখতে পান ফ্রিজের দরজা হালকা খোলা আর সেই হালকা খোলা দরজার ফাক দিয়েই ফিনকি দিয়ে গলগল করে রক্ত বেড়িয়ে পুরো ঘরের ফ্লোর ভাসিয়ে দিচ্ছে। এ পর্যন্ত দেখার পরই তিনি চিৎকার করে ওঠেন এবং ওনার ঘুম ভেঙে যায়। জামাল সাহেব  বুঝতে পারেন তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন এবং পুরোটাই তার স্বপ্ন ছিল। মিতু জলদি জামাল সাহেবকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করে এবং পানি এনে দেয়। কিন্তু জামাল সাহেব বুঝতে পারে যে এই ফ্রিজ নিয়ে সেদিন মিতু যা বলেছে তা কিছুটা হলেও সত্য এবং সত্যিই এই ফ্রিজের কোনো রহস্য রয়েছে। যাই হোক পরের দিন জামাল সাহেব ও তার বউ মিতু এক বন্ধুর বাসায় রাতে দাওয়াত খেতে যায়। বাসায় জামাল সাহেবের মা ছিল। দাওয়াত খেয়ে বাসায় ফিরে এসে অনেক ধাক্কাধাক্কি করার পরেও জামাল সাহেবের মা দরজা খুলছিল না। শেষ পর্যন্ত জামাল সাহেব লোক ডেকে এনে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। ভেতরে ঢোকার পর দেখে জামাল সাহেবের মা ডায়নিং রুমে মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মাথা ফেটে গেছে ও অনেক রক্ত ঝরছে। মিতু চিৎকার করে ওঠে। জলদি করে মাকে তারা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তার জ্ঞান ফিরে,  মাথা সেলাই করে দেয়া হয়। জামাল সাহেব তো ভেবেছিল তার মা মনে হয় মারাই গেছে। জ্ঞান ফিরাই দুশ্চিন্তা মুক্ত হোন তিনি। এরপর বাকি ঘটনা উনার মায়ের কাছ থেকেই শোনেন। জামাল সাহেবের মা জানায় তিনি এশার নামাজ পড়ে বসে জিকির করছিলেন। হঠাৎ ডায়নিং রুমে কিসের যেনও আওয়াজ এলো। তিনি ভাবলেন বিড়াল ঢুকেছে। জলদি তাই ডায়নিং রুমে এলেন বিড়াল তাড়াতে। কিন্তু এসে দেখে শব্দ হচ্ছে ফ্রিজের ভেতর থেকে। সাহস করে ফ্রিজের দরজা খুলেন। খুলে দেখেন ভেতরে কিছুই নেই। অথচ ফ্রিজের ভেতর থেকেই শব্দ হচ্ছিল। ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে পেছন ফিরে যখন তার রুমে ফিরে আসছিলেন তখন হঠাৎ করে পেছন থেকে ফিক করে বাচ্চা মেয়ের কন্ঠে হেসে ওঠার শব্দ আসে। পেছনে ফিরে তাকিয়ে উনি দেখেন ফ্রিজের ওপর একটি বাচ্চা মেয়ে বসে আছে। বয়স হবে ১১-১২ বছর বয়সের মতো। কিন্তু মেয়েটি পা ঝুলিয়ে বসে আছে ফ্রিজের ওপর আর মেয়েটির পা তার বয়সের তুলনায় অনেক লম্বা,, পা দুটো ফ্লোর ছুয়ে আছে। মেয়েটির চোখের কোটরে মনি নেই। পুরোটায় সাদা। খিল খিল করে হাসছে। রক্ত হিম করা হাসি। সাথে পচা লাশের বিকট গন্ধ। জামাল সাহেবের মা এটা দেখে দৌড়ে বাসা থেকে বের হতে যাবে এর আগেই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। তার মাথা ফেটে গেল৷ এরপর জ্ঞান ফিরে দেখেন তিনি হাসপাতালে। জামাল সাহেবের আর বুঝতে বাকি নেই যে এই ফ্রিজটিই যাবতীয় সব সমস্যার মূল। অতি দ্রুত তাকে এই ফ্রিজটি বাসা থেকে বার করতেই হবে। তিনি সাথে সাথে যে বন্ধুর থেকে ফ্রিজটি নিয়েছিল তাকে ফোন দেন। বন্ধুকে বলে ফ্রিজটি ফেরত নিতে আর এর বিনিময়ে তাকে কোনো টাকাও দিতে হবে না। কারণ জামাল সাহেব এখন ফ্রিজটি থেকে নিস্তার পেলেই বাঁচে। বন্ধু জানায় সে ফ্রিজ নিতে পারবে না। কারণ সে ঢাকায় এবং তার কাগজপত্র প্রায় রেডি ওমানে যাওয়ার জন্য। সে ওমানে চলে যাবে। জামাল সাহেব তার মাকে নিয়ে পরদিন সকালে বাসায় ফিরে আসে। জামাল সাহেব, মিতু ও তার মা সেদিন এক রুমে এক সাথেই থাকে। যে পর্যন্ত ফ্রিজটি ঘর থেকে বিদায় না হচ্ছে তারা একই সাথে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেদিন রাতেই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা। মিতু, জামাল সাহেব ও তার মা একই স্বপ্ন দেখতে পায়। স্বপ্নে তারা দেখে সেই ফ্রিজটি থেকে একটি প্রায় ১১ বছর বয়সী মেয়ে বেরিয়ে এসে তাদের বলছে, আমাকে খুন করা হয়েছে। জামাল সাহেব যার কাছ থেকে ফ্রিজটি কিনেছে সেই বন্ধু মেয়েটিকে খুন করেছে। মেয়েটি বলে সে জামাল সাহেবের বন্ধুর বাসায় কাজ করত। একদিন সে না জানিয়ে রান্নাঘর থেকে দুটো  বিস্কুট খেয়েছিল। আর এটি দেখে জামাল সাহেবের বন্ধু রাগান্বিত হয়ে মেয়েটিকে জোরে থাপ্পড় দেয়। আর এই থাপ্পড়েই মেয়েটির মৃত্যু হয়। এরপর জামাল সাহেবের বন্ধু ভয় পেয়ে যায়। তাড়াতাড়ি করে একটি ধারালো ছুরি নিয়ে এসে মেয়েটির শরীর কেটে টুকরো টুকরো করে এই ফ্রিজটিতে পলিথিনের ব্যাগে করে ভরে রাখে। এর ২ দিন পর ফ্রিজ থেকে আলাদা আলাদা ব্যাগে করে শরীরের টুকরো গুলো নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে আসে। মেয়েটির গ্রামের বাসায় জানায় যে মেয়েটি ঘর থেকে পালিয়েছে। মেয়েটি স্বপ্নের মধ্যে এসব ঘটনা বলে কান্নাকাটি শুরু করে। আর তখনি ঘুম ভেঙে যায় সবার। জামাল সাহেব, মিতু ও মা তিনজনই তাদের এই স্বপ্ন তিনজনকে বলে আর স্বপ্ন মিলে যাওয়ায় তারা এই ঘটনা বিশ্বাস করে নেয়। এছাড়া জামাল সাহেব পত্রিকায় দেখেছিল কাহরোলে একটি ছোটো মেয়ের হাত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এ সব ঘটনা তারা পুলিশকে বিশ্বাস করাবে কিভাবে। তাই তাদের কিছু করার থাকে না। হুজুর এনে দোয়া মিলাদ পড়ায় বাসায়। হুজুর সব শোনার পর জানায় কোনো মানুষেরই ক্ষমতা নেই মৃত্যুর পর এ দুনিয়ায় এসে হস্তক্ষেপ করার। কারণ ইসলাম ধর্ম মতে মৃত্যুর পরই মানুষ আলমে বারযাখের জগতে চলে যায় এবং সেখানে ইহজগতের কাজের হিসাব নেওয়া হয়। এটি কোনো জ্বিনের কাজ হতে পারে বলে জানায় হুজুর যে এই মেয়েটির ঘটনাটি অবলোকন করেছিল এবং জ্বিনটিই হয়তো স্বপ্নের মাধ্যমে তাদের সত্যটি জানিয়েছে। কিন্তু এসব জেনে জামাল সাহেবের কিছুই করার থাকে না। কারণ পুলিশ এসব জীবনেও বিশ্বাস করবে না। কিন্তু পরদিনই একটি সুসংবাদ আসে। পুলিশ নিজেদের মতোই তদন্ত করে বের করে ফেলেছে এতদিনে খুনিকে। জামাল সাহেবের বন্ধু এয়ারপোর্টে বিমানে ওঠার কিছুক্ষণ আগ মূহুর্তেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এদিকে জামাল সাহেবও সেই ফ্রিজটি ভেঙে চুরমার করে ভাঙারী দোকানে বিক্রি করে দেয়। এরপর আর কোনো সমস্যা হয় নি বাসায়। জামাল সাহেব নতুন একটি  ফ্রিজ কিনে আনেন।

 

আজ প্রায় ২ বছর হয়ে গেলো এসব ঘটনার। জামাল সাহেবের এখন সুখের সংসার। মিতু এখন প্রেগন্যান্ট। জামাল সাহেব ও মিতু দুজনেই চায় তাদের একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান হোক। জামাল সাহেব তার বাসায় একটা ছোট ১১ বছর বয়সের কাজের মেয়েও রেখেছে। সবাই কাজের মেয়েটিকে অনেক আদর করে। মেয়েটিকে মিতু স্কুলেও ভর্তি করিয়েছে। কাজের মেয়েটির নাম নিলীমা।

লেখক,

মোছা.সাবরিনা মমতাজ মম

পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ,

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *