বইটির ধরণ:
মূলত, বইটি একটি জীবনী গ্রন্থ বলা চলে। পাশাপাশি জীবনভর ব্যক্তির মহৎ কর্মের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। বইটি সাদাসিধা সহজ সরল ভাষায় রচিত। এটি একটি গবেষণামূলক বই ও খুবই তথ্যবহুল, যা সকল শ্রেণির পাঠক পাঠ করে মুগ্ধ হবে বলে আশা করা যায়, ইনশাআল্লাহ।
সারমর্ম:
বইটি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, সমগ্র ইস্তাম্বুলে (সমগ্র বিশ্ব) আলোর মশাল হয়ে জেগে উঠা একজন দার্শনিক,আলিম, মুজাহিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও কর্ম নিয়ে রচিত। এছাড়াও শাইখ সাঈদ নুরসি রহঃ এর, লেখা “রিসালায়ে নূর” এর কয়েকটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আলোকপাত করা হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে সাঈদ নুরসি’র দেওয়া উম্মাহ’র জন্য যুগোপযোগী দিক নির্দেশনা।
বইটির আলোচ্যে বিষয়:
বদিউজ্জামান অর্থ- কালের বিষ্ময়। সত্যিকার অর্থেই তিনি একজন বিস্ময়কর মানুষ, যিনি সমগ্র জীবন ব্যয় করে দিয়েছেন, উম্মাহ’র স্বার্থে।
তিনি ইসলামের একজন একনিষ্ঠ সিপাহসালার, যিনি কামালবাদের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার কলম চালিয়েছেন, মানুষকে করেছেন সচেতন, ছড়িয়ে দিয়েছেন ইসলামের আলো।একাধিকবার কারাবরণ করেছেন তিনি। যেখানে অবস্থান করেছেন, সেখানেই ছড়িয়েছেন দ্বীনের আলো। কারাবাস ও নির্বাসনের ২৭বছরে রচনা করেছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ অমর গ্রন্থ ”রিসালায়ে নূর”। এই রিসালায়ে নূর আজও বিশ্বে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, যার ছাত্র অযুত হারে বেড়েই চলেছে। প্রশান্ত আত্না ফিরে আসছে, তার মূলের দিকে, হেরার আলোয় আলোকিত হচ্ছে এই ত্রিভুবন।
বইটিতে যা রয়েছে:
বইটি ৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এখানে ৬টি অধ্যায়ের মাঝে ধাপে ধাপে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তা হলো:-
প্রাথমিক জীবন:
শুরুতে নুরসি রহঃ জীবনের প্রাথমিক দিক গুলোর বর্ণনা করা হয়েছে। পারিবারিক পরিবেশ, প্রাথমিক শিক্ষা লাভ ও ইলম অন্বেষণের বিভিন্ন শহর গমনে বিবরণ দিয়েছেন।
ওনার প্রাথমিক অভিভাবাক মা বাবা’র দুইটি উক্তি যা না বললেই নয়,
আমি এমন পরিচ্ছন্ন ছিলাম,যে চারণভূমি থেকে বাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় গবাদি পশুর মুখ বেধে নিতাম, যেন অন্যদের শস্যখেতে কিছু না খেয়ে ফেলে।
আমি আমার সন্তানদের সব সময় পবিত্র ও অজু অবস্থাতেই দুধ পান করাতাম।
এগুলো হলো প্রকৃত তাক্বওয়া।
নুরসির নব-আবির্ভাব:
ইস্তাম্বুল ও আস্কারায় অবস্থানকালে সাঈদ নুরসি আরবি ও তুর্কি ভাষায় কিছু বই লিখে__
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২২সালে বলিষ্ঠ যুক্তি ও সুতীক্ষ্ণ প্রমাণ সংবলিত “রিসালাতুত ত্বাবিআহ” রচনা করেন।
এই সময়ে কামাল আতাতুর্ক তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ইসলাম ধর্মের উপর আক্রমণ করে,কুরআনের উপর নিষেধাজ্ঞা, আরবি বর্ণমালা পরিবর্তন, আজান নিষিদ্ধ, টুপি পরিধান করা সহ ইসলামের বেশ কিছু বিষয় কে রাষ্ট্রীয় ভাবে পরিবর্তন করা শুরু করেন।
তখন,নুরসী রহঃ পাহাড়ি এক এলাকায় নির্বাসিত করা হয়।সেখানে তিনি “মাদরাসায়ে নুর” প্রতিষ্ঠা করেন।এই জীর্ণশীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় ছোট্ট একটি কামরায় আট বছর অবস্থান করেন।
এই ছোটো শান্ত গ্রামটি হয়ে উঠে ইসলামের আলোকবর্তিকা, কেননা এখানেই তাঁর অমর কীর্তি তাফসিরে রিসালায়ে নূরের বেশিরভাগ অংশ লিখেছেন।
রিসালায়ে নূরের বিজয়:
এই অংশ রিসালায়ে নূরের আলো নিভু নিভু করে বিশ্বে ছড়িয়ে পরতে লাগলো।তখন শুরু হয়, অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছে।তিনি তবুও থেমে যায়নি,তিনি জেলখানাকে মাদ্রাসায় রূপান্তর করেছেন।কয়েদিরা হয়ে উঠে তার ছাত্র। এভাবে তিনি সর্বাবস্থায় দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন।
কামাল আতাতুর্ক এর ঘৃণিত কর্মকান্ড দেখে যখন মানুষ হতাশ হয়ে যাচ্চিল__
তিনি বলেন এই বিপদ সাময়িকের জন্য, তোমাদের শিশুদের দ্বীন শিক্ষা দাও।ইনশাআল্লাহ পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে।
শেষবেলা:
এখানে নুরসী রহঃ জীবনের শেষের দিকে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী আলোকপাত করেছেন।
এই মনীষী জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত, নিজের দেশ জাতি তথা মুসলিম উম্মাহ’র জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন।
১৯৫২ সালে পাকিস্তানের শিক্ষা উপমন্ত্রী সাইয়েদ আলি আকবর তুরষ্ক সফরের সময়, কৃতজ্ঞ কন্ঠে নুরসিকে পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানান।তিনি জানেন পাকিস্তানে দ্বীনের অবস্থা তুরস্কের মত খারাব নয়।তবুও তিনি মন্ত্রী মহোদয় কে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন___
তুরস্ক আমার কর্মক্ষেত্র।জিহাদের ময়দান আমি ত্যাগ করতে পারি না।
কিন্তু, তবুও তিনি মৃত্যুর পর শান্তিতে কবরস্থ থাকতে পারেনি।রাষ্ট্রীয় চাপে তাকে এক জায়গায় প্রথমত কবর দেওয়ার পর।নোংরা ষড়যন্ত্রে কিছুদিন পর তা আবার স্থানান্তরিত করা হয়।যদিও এটি নুরসী রহঃ ইচ্ছে ছিল,তিনি এমন জায়গায় কবরস্থ হতে চেয়েছিলেন, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম তার কবর কে কেন্দ্র করে কোন শরিয়া বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে না পারে।আল্লাহ জালিমদের মাধ্যমে তার ইচ্ছে কে বাস্তবায়ন করেছেন।
রিসালায়ে নূর:
১৯২৯সালে কুরআনকে জনগণের অন্তর থেকে নিষ্ঠুরভাবে তুলে নেওয়ার অধ্যাদেশ জারি হলো।কিন্তু তার আগেই সে সময়ই বারলার নিভৃত অন্তরীণ কক্ষে দীর্ঘ আট বছরের বন্দি ও নির্বাসিত জীবনে সাঈদ নুরসি কুরআনের অবিস্মরণীয় ভাষ্য হিসেবে রচনা করলেন রিসালায়ে নূরের প্রথম ৪৮টি নিবন্ধ।
নুরসির ভাষায়-ই___
রিসালায়ে নূর হচ্ছে কুরআনুল কারিমের ব্যাখ্যার একটি বিষ্ময়কর প্রামাণ্যচিত্র ও মূল্যবান তাফসির,যা পবিত্র কুরআনের আধ্যাত্মিক আলোকচ্ছটার একটি উজ্জ্বল রশ্মি,কুরআন নামক সমুদ্রের অসীম কণারাশির একটি ফোঁটা, কুরআন নামক সূর্যের একটি কিরণ,রুহানি তত্ত্বজ্ঞানের শীর্ষচূড়ার আল্লাহ প্রদত্ত একটি হাকিকাত বা তত্ত্ব,কুরআন থেকে নিঃসৃত একটি আধ্যাত্মিক ভাষ্য।
رسالة نور
আরবি শব্দ, যার অর্থ -আলোকিত নিবন্ধ সমূহ বা আলোর পংক্তিমালা বা পথ নির্দেশক আলো।প্রায় ৬০০০অধিক পৃষ্ঠাসম্বলিত ১৪ খন্ডের একটি রচনা সংকলনের নাম রিসালায়ে নূর।লেখা হয়েছে আরবি এবং অটোম্যান তার্কিশ ভাষায়।এতে রয়েছে প্রায় ১৩০এর অধিক প্রবন্ধ (রিসালা) রয়েছে। এ পর্যন্ত বিশ্বের ৫২টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
আল্লাহ ওনার এই মহতী কর্ম কে কবুল করুক।বই সংশ্লিষ্ট সকলের কর্ম দক্ষতা আরও শানিত হোক।আমিন।
প্রিয় বাক্য:
_______রিসালায়ে নুর থেকে।
বর্তমান সময়ে এটা প্রমাণিত। ইউরোপে দিনদিন ইসলাম ধর্মের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আলহামদুলিল্লাহ।
____রিসালায়ে নূর,বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি।(রহঃ)
প্রশাসন কে লক্ষ্য করে বলেন,
নুরসী বলেন,অনেকেই কোনো সুফি মতবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়েও জান্নাতে প্রবেশ করবে,কিন্তু ঈমান ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
আর বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ উল্টো।
সাঈদ বদিউজ্জামান নুরসীর রহঃ এর প্রতিটি কথাই যুগোপযোগী ও মর্মস্পর্শী।
বইটি থেকে শিক্ষা:
তিনি ছিলেন কেবল কুরআনের একজন খাদেম। তিনি কামান ও বন্দুক দ্বারা কোন কাজ করেন না। তার বন্দুক ও কামান হলো শুধুই আল কুরআন।
কামাল আতাতুর্ক যখন টুপি পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করছিল,
তখন নুরসী রহঃ কে বলছিলেন পাগড়ী খুলে ফেলতে। তখন ওনার জবাব ছিল,
“আমার শিরশ্ছেদের পরেই এই পাগড়ি তোমারা খুলতে পারবে।তার আগে নয়।”
তুরস্কের প্রসিদ্ধ ইতিহাসবেত্তা জামাল কুতায়ের একটি মন্তব্য____
‘কামাল পাশার ছিল বিরাট সৈন্যবাহিনী, অস্ত্রসস্ত্র ও ট্যাংক।আর নুরসির ছিল ভাঙ্গা কলম।কিন্তু সময় আজ প্রমাণ করেছে,কামাল হেরে গিয়েছে, নুরসী বিজয়ী হয়েছে।
নিশ্চয়ই আমি এবং আমার দূতগণ বিজয়ী হবে।[সূরা-মুজদালাহা:২১]
লেখক,এম এম সাঈদ আব্দুল্লাহইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
Leave a Reply