মানিক গাছ – ছোটগল্প

মানিক গাছ
জল ও স্থল উভয়ই দূষিত। কয়েক প্রজাতির মৃত প্রাণীর পঁচে যাওয়া দেহ থেকে নিসৃত দুর্গন্ধ অদৃশ্য ধোঁয়ার মতো করে মিলছে বাতাসে । পুকুর-ভর্তি লোনা পানিতে পঁচে ফুলে উঠা রুই কাতলা মৃগেলের কোনো কোনোটার আঁশটে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আবার কোনোটার মুখ থেকে অবিরত বেরুচ্ছে রক্ত । পুকুরের পাশে বাবলা গাছের মাছরাঙা পাখিটা এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে সারাজীবনে আর মাছ খাবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে নিল।
এমনটাই প্রতিজ্ঞা করেছে আমাদের উত্তরপাড়ার মানিকের বউ সজুতি। সে মানুষ হিসেবে খুবই সৌখিন। কোনোরকম কাঁদাপানি কিংবা পিচ্ছিল অবস্থা তার একদমই ভালো লাগে না। অন্যদিকে মানিক প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে চলা একজন মানুষ। ঘূর্ণিঝড় আয়লার সময় তাদের উঠোনের বুক পর্যন্ত পানি ঠেলেও সে তার অসুস্থ মা’কে উঁচু ডাঙায় তুলেছিল। তাতে অবশ্য খুব একটা উপকার হয় নি। নিরাপদ আশ্রমে পৌছুতে না পৌছুতেই ওর মা বিধাতার নির্মল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল।
মানিক তবুও মরা মায়ের পদতলে বসে বসে ছোট শিশুর মতো কাঁদে নি। মা’কে কোনোমতে রেখে শেষবার মুখের দিকে অপলক চেয়ে দৌড়ে এসেছিল অসুস্থ বাবার কাছে। বাবা তার ছেলের বিষণ্ণ মুখ দেখে বারবার জিজ্ঞেস করেছিল,
“কী হুইছে মানিক?  মা রে কার ধারে দিলি?”
বাবাকে কোলে তুলতেই চাপা কান্নার বিস্ফোরণ ঘটলো মানিকের মুখে। ” মা নেই”  কথটা শুনতেই বাবা মোচড় মেরে লাফিয়ে পড়লো ছেলের হাত থেকে। ডুবে গেল পানিতে। মানিক চেষ্টা করলো বাঁচাতে কিন্তু তার বাবা পানির নিচের মেহগনি গাছের শিকড় আঁকড়ে ধরলো জীবনের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। বোধহয়,  মৃত্যুকে সে ডেকে আনলো তার স্ত্রীর সাক্ষাৎ লাভের আশায়। 
ভাটির স্রোতে মা বাবাকে ভেসে যেতে দেয় নি মানিক। মা’কে বাবার কাছে এনে গাছের উপরের অংশে বেঁধে রেখে ঐ মেহগনির তলায়-ই  দুজনকে কিছুদিন পরে সমাহিত করেছিল সে।
এসব অবশ্য একযুগ আগের কথা। এটা ‘আয়লা’ নয় বরং ‘ইয়াস’। এটাতে নয় দশ নম্বর সতর্কতা সংকেতও দেওয়া হয় নি অথচ বাঁধ ভেঙে লোনা পানি ঢুকলো। এতোটাই আকষ্মিকভাবে ঢুকলো যে, শুক্রবারে সৃষ্টিকর্তার পানে মসজিদে সেজদাহরত ইবাদতকারীগণের অনেকেরই জুতো ভেসে গেল। কেউ পেল, কেউ পেল না। কিন্তু তাতে তাদের খুব দুঃখ নেই। বস্তুত জুতার কোনো প্রয়োজনীয়তা-ই থাকলো না তখন। সবাই ছুটলো উন্মুখ হয়ে। বুকে আতঙ্কের হাহাকার নিয়ে ছুটলো সবাই। কেউ উন্মুক্ত ময়দানে থাকা গরুর বাঁধন খুললো,কেউ বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে জল আটকাবার বৃথা চেষ্টা করলো, কেউ পরিবারের অসুস্থ সদস্যকে গোটোসোটো করে তুলে দিল চালের উপরে, কেউ দেয়ালটা ঠিকঠাক আটকাতে লাগলো ইত্যাদি। কিন্তু সবার মধ্যেই একটা সদৃশতা ছিল। তা হলো আহাজারি, আতঙ্কের চিৎকার,গগনবিদারী কান্নার বেদনাদায়ক চিৎকার প্রভৃতি। 
জোয়ার শেষে ভাটায় পানি সরে যাওয়ার সাথে সাথে রাত গভীর হলেও মানুষের চোখ ছলছল হয়ে জ্বলতে থাকে আনন্দে। কিন্তু আনন্দ সীমিত সময়ের জন্য। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল সেই আনন্দের আলো।
এইভাবে দুইদিন জোয়ার ভাটার সাথে এলাকার মানুষের সুখ দুঃখের একটা চমকপ্রদ পরিচয় হয়ে গেল।
চতুর্থ সকালে মসজিদ থেকে এলার্ম আসলো, গ্রামের বৃদ্ধ মতিন মিয়া মারা গেছে। এই খবরে কেউ খুব একটা মর্মাহত হলো না। কেননা মতিন সাহেব দীর্ঘদিন ধরে অসুখে ভুগছিল। যিনিই তাকে দেখেছেন তিনিই বলেছেন, এর থেকে মরাই ভালো। 
মরেছে সমস্যা নাই কিন্তু তাকে কবরস্থ করা হবে কোথায়?  কীভাবে? এটাই তো সমস্যা।  সর্বত্রই তো জল! লোনা জল! জোয়ারের পানিতে জল উঠছে ঠিকই কিন্তু নামছে না অত সহজে। পুনরায় জোয়ার এসে পুনরায় পানি বৃদ্ধি করে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে দ্বিগুণ। 
সবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লাশকে ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু মানিক এটা মেনে নিতে পারলো না। মরা জীবজন্তু আর মানুষের বিষ্ঠার মতো নিকৃষ্ট জিনিসে দূষিত পানিতে লাশটাকে কোনোভাবেই ছেড়ে দিতে নারাজ সে। 
মানিক লাশটাকে ঠিকই আঁকড়ে ধরলো এবং  তার বাবা-মায়ের সমাধিস্থলের সেই মেহগনি গাছের সাথে পানি থেকে খানিকটা উঁচু করে বাঁধলো। আর অপেক্ষা করতে লাগলো কখন পানি কমে ! কখন ভাঁটা হয়!
অন্যদিকে লোনা পানিতে প্রতিকূল পরিবেশেও বছরের পর বছর বেঁচে থাকা এই মেহগনি গাছটিকে গ্রামের মানুষ “মানিক” বলে ডাকে।
~~সমাপ্ত~~
লেখক,
মুতাছিম বিল্লাহ নয়ন
 সরকারি পি সি কলেজ বাগেরহাট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *