জীবন গল্প

জীবনের সেরা অর্জন – ২

 

পর্ব – ২

দেখতে দেখতে ভালোই বড় হলাম। ২০০৭ সাল কেজি ওয়ান থেকে সবে মাত্র ২য় শ্রেণীতে উঠেছি । আমাদের এখানে ২য় শ্রেণীতে কেউ কোনো স্কুলে  ভর্তি হয় না। কারণ সবার লক্ষ্য থাকে ৩য় শ্রেণীতে জিলা স্কুলে পরীক্ষা দেয়া। সবাই কোনো না কোনো  কোচিং বা প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে। লক্ষ্য একটাই জিলা স্কুলে একটি সিট পাওয়া। তো আমিও যথারীতি একটি নামকরা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলাম। আম্মা বললেন সামনের বছর তো ভর্তি পরীক্ষা দিবি। বড় একটা পরীক্ষা ভয় পাবি। কেমনে কি হয় একটু ধারণা নেওয়ার জন্য এইবার পরীক্ষা দিয়ে দেখ তাইলে সামনের বছর তর জন্য জিলা স্কুলে চান্স পাওয়া সহজ হব। এর পর বছরের শুরুতে মা ভর্তি ফরম তুলে আনলেন। কোনো রকম পড়া ছাড়া পরীক্ষা দিলাম। অনেকেই এইভাবে পরীক্ষা দেয়। এটাকে আমাদের এখানে বলা হয় ভয় কাটানো। আমিও ভয় কাটানো পরীক্ষা দিলাম। চান্স হলো না। না হওয়াটাই স্বাভাবিক কোনো রকম সিরিয়াস ছিলাম না। এরপর আমি আমার কোচিং এ ভর্তি হলাম। আমার সাথে আরো ৫ জন এলাকার বন্ধু একই কোচিং এ ভর্তি হলাম। কিন্তু এর মধ্যে ২ জন সুযোগ পেলাম সকালের সময় আর ৩ জন ভর্তি হলো দুপুর সময়ে। তো ভালোই দিন যাচ্ছে। অনেক চাপ। দৈনিক পড়া দৈনিক পড়া লাগে নইলে পিছায় পরা নিশ্চিত। আমাদের বিষয় ছিলো ৩ টা। প্রতিদিন ৩ টি বিষয়ই পড়ানো হতো আর সেটার উপর ক্লাস পারফরমেন্স নির্ধারণ হতো। ৩ টি ক্যাটাগরি ছিলো। গুড,ভেরী গুড,নট সো গুড। সবাই ভেরী গুড পাওয়ার জন্য পাগল থাকত। যারা নিয়মিত ৩টি বিষয়ে ভেরী গুড পেত তারা ‘এ+’ গ্রেড  পেত। গুড পেলে ‘এ’ গ্রেড। এভাবে এ+ নিয়মিত পেলে সপ্তাহ শেষে তাদের পুরস্কৃত করা হইতো। পুরস্কার হিসেবে খাতা দিতো। যখন খাতা পেয়ে বাসায় আসতাম মনটা খুশিতে ভরে যেত। মা খুব খুশি হতো। আর সাহস যোগাত এভাবে ভালো ভাবে পড়লে চান্স পাবি। আর পাইলে সবাই কতো ভালো হব আর যদি চান্স না পাস তাইলে তুই নিজেই মানুষের সামনে মুখ দেখাবার পাবি না। বলতো, ‘ চান্স না পেয়ে যখন বাইরে যাবি মানুষ সাথে সাথে জিজ্ঞাস করব চান্স পাইছো কিনা ‘। মা বলতো, তখন বুঝবি কেমন লাগে। মুখ দেখাইতেও লজ্জা পাবি। হ্যাঁ, আমাদের এখানে তখন ভালো কোনো স্কুল ছিলো না। এখন অনেক স্কুল হইছে। তো জিলা স্কুলই এমন একটা স্কুল যেখানে চান্স না পাইলে যেন জীবনটাই বৃথা। এটা এমনই এক স্কুল আপনি এর মায়ায় পরতে বাধ্য। আটটি বছর এখানে পড়ানো হয়। একে অপরের কতোটা আপন হয় তা অন্য কোথায় দেখা যায় না। সুখে দুখে সবার আগে জিলাস্কুলিয়ান। সত্যি কথা বলতে, আপনি যদি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাস করেন, এখন পর্যন্ত তোমার জীবনের সেরা অর্জন কোনটা। আমি বলব” জিলা স্কুলে চান্স পাওয়াটা আমার জীবনের সেরা মূহুর্ত”। ১০০ বার বলতে বললে আমি ১০০ বারই এই উওর দিবো। আমাদের জিলা স্কুলে তখনকার সময়ে ভর্তি ফরম ছাড়তো ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির শুরুতে । তো ২০০৮ সাল, মা স্কুল থেকে ভর্তি ফরম তুলে আনলেন। পরীক্ষার আগের কয়েকটা দিন ভয়,আতঙ্কে গেছে। শুধু এক চিন্তা চান্স না পাইলে যে কি হবে। আমি তো শেষ তাইলে। পরীক্ষার দিন বাবা মা সাথে গেলেন। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মা অনেকগুলো দোয়া বলে বুকে ফুঁ দিয়ে দিলেন। রাস্তায় পরিচিত যাদের সাথে তাদের কাছেও দেয়া চাইলাম। আগের দিন বাসার আশেপাশের মানুষদের কাছেও দোয়া নিয়েছি। স্কুলের সামনে গেলাম। বিশ্বাস করেন পা ফালানের জায়গা নেই। একেকটা ছাত্রের সাথে ৪/৫ জন মানুষ। অনেকের বাবা,মা, ভাইবোন, চাচা -মামা সবাই আসছেন। পরীক্ষার্থী ছাড়া সবাই গেটের বাইরে। কাউকে ভিতরে যাইতে দেয় না। অনেক কষ্টে স্কুলের ভিতরে প্রবেশ করলাম। বাবা মা বাইরে থেকে গেলেন। গেট থেকে একা যখন ডুকলাম নিজেকে সব থেকে বড় অসহায় লাগছিলো। কাউকে চিনি না  কাকে কি বলব বুঝতেছিলাম না। ডুকার পর সামনেই এক লোক বললেন, ‘বাবু দেখি তোমার প্রবেশ পত্র ‘। তিনি দেখে বললেন ঐদিকে তোমার সিট পরছে। রুম নাম্বারটা ছিলো ৩১১। একটু পর পরই ১/২ মানুষ যারা কিনা এভাবে পরীক্ষার্থীদের রুম নাম্বার বলে দিচ্ছে। আমি ভাবলাম এরা কারা। পরে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর জানতে পারি তারা এই স্কুলেরই শিক্ষক। তো আমি আমার সিটে গিয়ে বসলাম। এক ব্রেঞ্চে ২ জন করে। ১০ টায় পরীক্ষা শুরু হলো। অনেক কিছুই কমন ভালোই দিলাম। একটা অংক, আর একটা ইংরেজি ট্রান্সলেশন পারি নাই। পরীক্ষা দিয়ে বের হলাম।বের হয়ে মাঠের মধ্যে এতো মানুষ। দেখেই মাথা ঘুরে গেলো। কোথায় আমার বাবা মা। অনেক খোজার পর বাইরে এক হোটেলের সামনে পেলাম। সবাই এক কথা কেমন হলো পরীক্ষা, কোনোটা বাদ পরছে কিনা। বললাম আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালোই দিছি। পরে বাসায় আসার পর চিন্তা কি যে হবে। সব রেখে বন্ধুদের সাথে খেলতে গেলাম। আর নামাজ কালাম পরতেছি দোয়া করতেছি। পরেরদিন সকাল বেলায়ই রেজাল্ট দিয়ে দেয়। আমার আবার প্রতি শুক্রবার করে রুটি খাওয়ার অভ্যাস ছিলো। পরে বাবা গেলেন স্কুলে রেজাল্ট আনতে। তো আমার রোলটা পেলেন। বাসায় এসে খুশির খবর পাওয়ার পর কি যে আনন্দ লেগেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। পরে বাবা আমাকে নিয়ে হোটেলে গেলেন রুটি আনতে। সকাল- সকাল এতো মানুষ ছিলো না। পরে রুটি কিনে আনার সময় এক আংকেলের সাথে দেখা। উনি আমাদের বাপপুতের হাসিমুখ দেখেই বুঝে ফেললেন চান্স হইছে। পরে বললাম ‘জি আংকেল আলহামদুলিল্লাহ্‌ চান্স হইছে’। আংকেল মজা করে বললেন, রুটির দাওয়াত দিবা না!! তো এভাবেই আমি আমার জীবনের সেরা একটা উপহার পাই। এজন্য আল্লাহ্‌র কাছে হাজারো শুকরিয়া। জীবন শুরুর প্রথম (কঠিন মূহুর্তগুলোর ) অভিজ্ঞতা এখান থেকেই শুরু। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link