চেতনায় সুখ -২
চেতনায় সুখ-২
নয়নের মা বৃদ্ধ বাবলু দার কাছে এসে ধন্না দিয়ে পড়লো…জানি,,, ময়না একটু ডানপিটে তবুও ওকেই আমাদের ঘরের বউ করে চাই।
”একই গ্রামের চেনা জানা এমন ছেলেই বা পাবা কই বলো”
বাবলু দা বিরক্তির স্বর নিয়ে বলেন,,,- ”আজকালকার ছেলে মেয়ে কি বলার আছে গো নয়নের মা,, আমার রনি ঢাকা থাইকা ফিরুক বাড়িতে,, কথা কইয়ো।”
এই পর্যন্তই তাদের কথা।
কিছুক্ষণ পর ময়নার আগমনে নয়নের মায়ের মিষ্টি হেসে বিদায়।
এবার একটু পরিচয় করিয়ে দেই,-
অল্পে সুখী থাকা সেই বাবলু দা-মানুষ টা স্ত্রী রেহানা বেগম কে হারিয়ে বিপত্নীক হয়েছে মাস চারেক আগে।
ময়না-বাবলু দা’র সবথেকে ছোট কন্যা যে সুন্দরী,ছটফটে সর্বগুণে সেরা মেয়ে এবং রনি বাবলু দা’র বড় সন্তান বর্তমানে পুলিশ সার্জেন্ট হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে কদিন আগেই যোগদান করেছে অন্যদিকে মেজো ছেলে নাম জনি; বখাটে,নেশাখোর, অকাজের হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
বাবলু দা’র মনে পরে এইতো ক বছর আগের কথা,, রনির এডমিশন এর জন্য কত কষ্টে ধার দেনা করে টাকা জোগার করতে হলো তাকে। এখন সেই কষ্টের দিনের সমাপ্তি হতে যাচ্ছে।
রনি ৭বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিলো-সেই খুশি যেমন ছিলো তেমনি ছিলো কিভাবে তার ছেলে কে পড়াশুনা শেষ করিয়ে বের করে আনবে।
গ্রামের পরিবেশে বড় হওয়া রনির প্রথম ঢাকায় আগমন ছিলো যেন এক নতুন প্রাণের বিচরণ।
প্রথম দিকে শহরের হাব ভাব বুঝে নিতেই তার কয়েক মাস চলে যায়,,বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি, আড্ডা, খাই দাই সব মিলিয়ে ভালোই যাচ্ছিলো। যখন টাকা চায় তার বাবা গ্রাম থেকে টাকা পাঠায়।
এমন ও একটা দিন গেছে যে বাবলু দা’র বাড়িতে সব মিলিয়ে ৭০টাকা আছে কিন্তু রনির টাকা লাগবে,, সে বিকাশ এজেন্ট এর লোকের কাছে অনুরোধ করে ২০০০টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে যা খুব কষ্টে শোধ করতে হয়েছে।
অন্যদিকে ছোট ছেলেটা পড়াশুনা বাদ দিয়ে মেকানিকের কাজে ঢুকেছে। যে কয়টা টাকা পায় নেশা দ্রব্য কিনে খেতেই তার হয়ে যায়।
বাড়িতে ফিরে লাল চোখে বাবা মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার, জিনিস পত্র ভাংচুর আর দোষারপ করা যে আমার ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারো নাই আমার, কি করছো আমার জন্য ?!!!!
আমাদের মানুষ দের একটা স্বভাব
“যখনই নিজের কমতি সামনে চলে আসে অন্যের উপরে দোষ ফিয়ে ক্ষ্যন্ত হই যদিও তা মানসিক অশান্তি দেয়। “
জনি ছিলো খুব ভালো মনের কিন্তু ওইযে দোষ,,
“নেশায় আসক্ত ছেলেগুলা খুব সহানুভূতি নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে জানে “
যার দরুন রেহানা বেগম বাবলু দা কে না জানিয়েই নিজের অদিনের সম্বল কানের দুল,হাতের চুড়ি সব দিয়ে দিয়েছে।
এরই মাঝে একদিন রনি বাসায় ফিরেছে। সেদিন জনিও আগে ভাগেই এসেছে।রনি সাথে করে এনেছে বোনের জন্য নিত্যদিনের মত সদাই, যেটা রাত্রীবেলা সবাই মিলে কাঠগোলাপ গাছ টার নিচে বাশের চাতাই এর উপরে শুয়ে-বসে রনির বিশ্ববিদ্যালয় এর নতুন নতুন গল্প শুনছে আর খাচ্ছে।
ওদিকে মাঝে মাঝে ফিরে গিয়ে রনির মায়ের রান্না শেষ। হেসেল থেকে আওয়াজ আসছে গল্প শেষ হলে সবাই খেতে আসা হোক।
অনেকদিন পর একসাথে বসে সরষে ইলিশ,পুটি মাছ ভাজা,নদীর বড় বোয়াল মাছ ভোনা, বাসায় পালিত হাসের মাংস সবমিলিয়ে স্বর্গাহার যেন।
দুদিন পর ই রনিকে চলে যেতে হচ্ছে। জনি আর বাবলু দা সকালে বেড়িয়ে গেছে কাজে,, ময়না আর তার মা রনি কে কান্না চোখে খাবার দাবার আর ব্যাগ গুছিয়ে বিদায় দিচ্ছে।
রনি বোধ করছে এই বুঝি এতো কষ্ট বিদায় নেয়া!!! পিছন না ফিরে বুকে কান্না চেপে স্টেশনে এসে বসে। কিছুক্ষণ পর ই তার শহরযাত্রা; ভুলতে থাকে সে বেদনা। চলতে থাকে তার ক্যাম্পাস লাইফ।
এরই মাঝে চলে গেছে অনেকটা সময়,
প্রেমে পড়েছিলো রনি এক মেয়ের
যাকে ভেবে তার মনে বাজতো রবীন্দ্রনাথের সেই দুটি লাইন ওগো বধু–
“বক্ষ বাঁধি বাহুপাশে, স্কন্ধে মুখ রাখি
হাসিয়ো নীরবে অর্ধ-নিমীলিত আঁখি”
যাকে কোনদিন বলা হয়েই উঠে নাই, যার সুমধুর মিষ্টি কথায় ,ভুবন ভুলানো হাসিতে বিভোর থাকতো,,না চাইতেও আগ বাড়িয়ে সমস্ত কাজ করে দিতো রনি। অপ্রকাশ্য সুগভীর ভালোবাসা বুঝে শুনেও বাস্তবতা মেনে নিরব আবেদন উপেক্ষা করে মেয়েটি একদিন আমেরিকান এক লাটসাহেব কে বিয়ে করে দেশ ছাড়লো।
রনি আর কষ্ট পায় না যদি ও কিছু সময় অন্ধকারে কাটিয়েছে তবু ও এখন তার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা,সকাল সন্ধে মিলিয়ে ৪টা টিউশন শেষ করে রুমে ফিরে রাত ১০টায়। ভাবনায় থাকে কিভাবে ভালো একটা চাকরি করবে, বোন কে পড়াবে, মায়ের চিকিৎসা করাবে।
দিন শেষে একটা ফোন কল আর পরিবারের সবার কন্ঠস্বরের সাথে সাথে যেন নতুন করে উজ্জীবিত হয় তার চেতনা শক্তি, তাকে পারতেই হবে আর সে পারবেই।
ওদিকে বাড়িতে তার ভিন্ন রূপ। কদিন আগেই তার মায়ের অন্ত্রে ক্যান্সার ধরা পড়েছে যেটা ময়না আর রনি জানে। দুই ভাই বোনের ফোনকলে আলাপ আলোচনা কিভাবে কি করা যায় বাবা আর জনি কে না জানিয়ে
তার বাবা একদিন বলেই ফেলে,,
মা রে,, ময়না,,বাবার চোখ ফাকি দিয়ে কান্না করিস মায়ের জন্য,, সত্য লুকানো এতই সহজ রে মা!!!
ময়না বাবা কে জড়ায় কান্নার জোয়ার বইয়ে দেয় যা পাশের রুম থেকে রেহানা বেগম শুনে ফেলে। বহু কষ্টে চলতে থাকে তার চিকিৎসা।
ময়না দুরন্ত মেয়ে সে পারে না এমন কোনো কাজ নেই।
বাবলু দা’র ও বয়স বাড়ছে। কাজে থাকে সেই ফাকে তার মেয়েটি হিজাব বাধিয়াই সংসারের বাজার, মায়ের ঔষধ সমস্ত কেনাকাটা করে।
এক বৃদ্ধা একদিন বলেই উঠেছিলো: ছেলের ধরনে চলে যেভাবে ছুড়ি টা বিয়ে কিভাবে হবে বাবলুর মেয়ের!!
কদিন পরে বৃদ্ধার কি এক দরকারে ডাক পরে ময়নার,,, “যাচ্ছিস তো বাইরে আমার ছেলের পাঠানো টাকা টা বিকাশ থেকে তুলে ঔষধ কিনে আনিস তো মা।”
কিছু মনে না রেখে সমস্তটা ঢেলে সাহায্য করে দেয় গ্রামের মানুষের ময়না।
দিন দিন মায়ের শরীরের অবস্থার অবনতি দেখে ময়না জনি কেও জানিয়ে দেয়। জনিদের ভালোবাসা আবেগে আসে না -ওরা ভালোবাসে রাগ দেখায়ে…. মায়ের সাথে রেগে কথা বলতে গিয়ে কান্না করে ফেলে।
কদিন পর ই দুনিয়া ত্যাগ করে চলে যায় রেহানা বেগম।
বাবলু দা সঙ্গী হারা হয়ে একেবারে ভেঙ্গে পড়েন।
এই অবস্থায় তার সম্বল হয় তার মেয়ে ময়না।
মায়ের মত করে সামলে নেয় ভাইদের, বাবা কেও আদরে আহলাদে ভুলিয়ে রাখে।
ময়না বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্লাসে যায় প্রতিদিন ৭কিলো রাস্তা ভ্রমণ করে আবার ফিরে এসে বাড়িতে। চুলায় রান্না বসায়, বাবার খেয়াল রাখে,,প্রতিবেশীদের ডাকে সাড়া দেয়।
তার নিজের চুলোয় খাবার না থাকলেও সে অন্যের বাসায় চুলা ফেলে দিতে যায় আবার মাঝে মাঝে নিজে না খেয়ে অন্যের মুখে খাবার তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরে।
এইসব করেই চলছে তাদের জীবন।
বেদনায় ও ভালো থাকা নিয়ে সজীবতা নিয়ে।
জনি এখন অনেকে শান্ত হয়ে গেছে, ভাবতে শিখতেছে দুই দিনের দুনিয়া, ধীরে ধীরে ফিরছে ভালোর পথে।
দুই বছর নাগাদার চেষ্টার পর সম্প্রতি রনির পুলিশ সার্জেন্টের চাকরি টা হয়েছে বাবলু দা’র মুখের হাসির ছটা বুঝিয়ে দেয় বলে দেয়:-
“ওগো রেহানা দেখে যাও বলেছিলাম না আমদের রনি একদিন মুখ উজ্জ্বল করবে এইতো সেদিন আমাদের সুদিন ফিরেছে “
এভাবে ভাবতে ভাবতেই দিন যায় বাবলু দা’র
চাকরি টা হওয়া থেকে মেয়ের বাপেদের যেন সোনার হরিণ হাতে পাবার লোভে রনির বাড়িতে নিত্য আগমন।
শুধু সেটাই না এখন সেই ডানপিটে ময়না কেও তাদের বউ করে নিতে ইচ্ছে করে সোনার হরিণের বোন বলে।
এখনও রনি, ময়না ও জনি কে নিয়ে বাবলু দা’র কত স্বপ্ন…..
এভাবেই চেতনায় সুখ জাগানো অনুভূতির রাজ্যে আমাদের অবিরাম চলন।
সেই সুখেতে ডাকিয়া কয় মনের মানুষ
“কোথা আছো ওগো,করহ পরশ নিকটে আসি।
কহিবে কথা, দেখিতে পাবো নীরব ওই হাসি।”
–নাসরিন আখতার
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।