বই রিভিউ

কবি – তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় (বই রিভিউ)

“তার্কিক দোহার লোকটি ছাড়িলো না, বলিল, – হাসির কথা নয় ওস্তাদ । পরকালে কি জবাব দেবে বলো!
নিতাই হাসিয়া বলিল- কোনো জবাব দেবনা‌ । চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবো ভাই।”
আমার কাছে পুরো উপন্যাস টির এই লাইনগুলো অনেক আকর্ষণীয় । সমাজের এক অছ্যুত , পরিত্যক্ত , ঘৃণিত জনগোষ্ঠী পতিতারা। এঁরা দিনের আলোয় নারী পুরুষ সবার কাছে অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু রাতের আঁধারে পুরুষের বিনোদনের খোরাক। “নিশি ফুরালে কেহ চায়না আমায়” এই কথাটা এই জনগোষ্ঠীর নারীরা জানেন। কথাটির মর্মার্থ বোঝেন।অথচ যারা এদের পতিতা বানায় তারা দিব্যি সমাজেই রয়েছেন। “কবি” উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে আজ থেকে বহু যুগ আগের। যখন একবিংশ শতাব্দীর জন্ম হয়নি তখনকার। ঐ সময়ে দাঁড়িয়ে এইরকম একটি উপন্যাস লেখা অন্যতম সাহসিকতার পরিচয় দেয়। যে সময়ে তথাকথিত পতিতালয়ের ভালোবাসা তো দূরের কথা সমাজে জায়গা দেওয়া যেতোনা। সময় পাল্টেছে। কিন্তু এঁদের অবস্থান পাল্টায়নি। এঁরা এখনো সভ্য সমাজে ঘৃণীত। এঁদেরকে ভালোবাসা অনেক দূরের ব্যাপার এরা ছুঁয়ে দিলেই অপবিত্রতা ভর করে আমাদের ওপর। অথচ দেবি দূর্গার প্রতিমা তৈরির জন্য পতিতালয়ের মাটি প্রয়োজন। এর থেকে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায় যে ,নারী যাই হোক না কেন নারী দেবী দুর্গার অংশ, মায়ের অংশ, সৃষ্টির সূচনা।
 এখন উপন্যাস এ ফেরাযাক। এই ঘৃণ্য সমাজের নারীদের শুধু ভোগ করা যায়, ভালোবাসার মত পবিত্র শব্দ এদের সাথে যায়না। এদেরকে দিনের আলোয় অবজ্ঞা করা যায়। রাতে কাছে টেনে নেওয়া যায়। নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য ‌ । সেই অচ্ছ্যুত ঘৃণ্য “বসন্ত” কেই নিতাই ভালোবেসে ফেললো। নিতাইয়ের জীবনে ঠাকুরঝির ভূমিকার থেকেও বেশি দাগ কাটে বসন্তের থাকার সময় টুকু। বসন্ত যেনো সত্যিই বসন্ত। বসন্তঋতুর মতোন প্রাণোচ্ছল। বসন্ত মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় নিতাই তার যা সেবা শুশ্রূষা করেছে সেটি একজন স্বামীও তার স্ত্রীর জন্য করতে লজ্জা বোধ করতেন সে সময়ে। ধর্ম, কর্ম ,জাত ,পাত, ভালো ,খারাপ সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে যে কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসা যায় কবি উপন্যাসটিতে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় নিতাইয়ের মধ্যে দিয়ে সকলকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।নিতাই একজন কবি। তার জাতের কেউ কোনো জীবনে এত স্পর্ধা দেখাতে পারেনি যে কবি হওয়ার যোগ্যতা তারা রাখতে পারে। নিতাই তার জাতের উর্ধ্বে গিয়ে নিজের মধ্যেকার অন্তরাত্নার ডাক উপলব্ধি করেছে। শত বাধাবিপত্তি , নানান অপমান, বিভিন্নভাবে তার জাত তুলে তাকে ছোট করা তাকে দমাতে পারেনি। নিতাই যে কারো জন্যই একজন প্রেরণা। নিতাই  এর কাছ থেকে আমরা উজ্জীবিত হতে শিখি। এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পাই। শুরুতে উল্লিখিত লাইনগুলো উপন্যাসটির প্রাণ সঞ্চার করে ‌ । উপন্যাস টির ঐ সময়ে বসন্তের মৃতদেহ সৎকারের উদ্দেশ্যে যখন কেউ থাকেনা। নিতাই একা সেই মৃতদেহ সৎকার করে। এবং সে সৃষ্টিকর্তার কাছে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন  হলে চুপ করে থাকবে বলে উত্তর দেয়। কথাটিতে নিতাই নিরবে এটাই বুঝিয়ে দেয়। জীবিত থাকতে যে আমার কাছে অচ্ছুত হয়নি। মৃত্যুর পরও সে আমার কাছে পবিত্রতার প্রতীক। 
সর্বোপরি , কবি উপন্যাসটিতে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় তৎকালীন সমাজের কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন। এবং এতকিছুর মধ্যেও নিতাই এর মত একটি অসাধারণ চরিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন বিভিন্ন ভাবে। তার জীবনের চড়াই উতরাই। প্রেম , ভালোবাসা এবং তার কবি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সব ই শিক্ষণীয়। 
আমার কাছে” কবি” অসাধারণ একটি উপন্যাস।
লেখক,
শতাব্দী চৌধুরী
মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

One thought on “কবি – তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় (বই রিভিউ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link