জীবনী

অমর কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদঃ প্রস্থানের ৯বছর

৩হুমায়ুনে জড়িয়ে আছে বাঙালি সংস্কৃতির সাম্প্রতিক আঙ্গিনা যাদের একজনের বই পড়ে, একজনের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে আরেকজন মুক্তভাবে চিন্তা-ভাবনা করার পথ দেখিয়ে গেছেন।তাঁরা হলেন— হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন ফরিদী এবং হুমায়ুন আজাদ। আজ জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের নবম দেহত্যাগ দিবস। কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, শিক্ষক সংস্কৃতি জগতের গুরুত্বপূর্ণ সব শাখায়তেই সােনা ফলিয়েছেন তিনি যা বাংলাদেশের স্বাধীনত পরবর্তী আর কোনাে লেখক তার লেখা দিয়ে মানুষকে এতােটা প্রভাবিত করতে পেরেছেন কি না প্রশ্নের বিষয়! পরিপক্ক হাতের লেখার জাদুতে সকলেই বিমােহিত হতেন।

 

জনপ্রিয়তার শীর্ষে

আসলে খুব কাছে থেকে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সরল অনুভূতিগুলােকে গল্পাকারে হুমায়ূন আহমেদ খুব সহজ সাবলীল ভাষায় তুলে ধরতেন। পাঠকের মনে হতাে এ বুঝি আমাদেরই গল্প! তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই দেশে বিশাল তরুণ পাঠকসমাজ তৈরি করা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর মানুষ তার লেখা গােগ্রাসে গিলতেন। তিনি না জন্মালে হিমু, মিসির আলী কিংবা শুভ্রকে বাঙালি কোনদিনই চিনতাে না।বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, আত্মজীবনী, শিশু-কিশােরদের জন্য গ্রন্থ, হিমু সিরিজ, মিসির আলী সিরিজ, শুভ্র সিরিজ, ভ্রমণকাহিনীসহ নানা বিষয়ে দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ।

 

মুক্তিযুদ্ধে হুমায়ুন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদকেও ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে কিছুদিন আটক করে রাখে এবং দৈহিক নির্যাতন করে। এসব কারণেই তিনি হয়তাে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প-উপন্যাস-সিনেমায় অনেক বেশি আগ্রহী ছিলেন। তার শ্যামল ছায়া, আগুনের পরশমণি, জোছনা ও জননীর গল্প মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়টার কথা মনে করিয়ে দেবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার প্রতিটা লেখা, প্রতিটা কাজ চোখ ভিজিয়ে দেয় আমাদের।

 

রচনার আঙ্গিক

বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখা, চরিত্র নির্মাণ, গল্প তৈরি, লাগসই সংলাপ রচনা— এ সব কিছু মিলিয়ে তিনি এক অভিনব ধারা সৃষ্টি করেন, যে শৈলী একান্তই তার নিজস্ব। রসবােধের কারণে তার রচনা খুব সহজেই পাঠকের মন জয় করে নিয়েছে।দেশের কথাশিল্পে গতানুগতিক ধারাকে অতিক্রম করে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন এক নিজস্ব ভুবন। সফল লেখক হিসেবে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বুদ্ধিদীপ্ত বিচরণ তাকে এনে দেয় অভাবনীয় জনপ্রিয়তা। গল্পের ভেতর বিচিত্র মানুষের সন্নিবেশ তার রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

 

নন্দিত নরকে ও একজন উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রজ্জ্বলন

তিনি এদেশের সৃজনশীল সাহিত্য প্রকাশনাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বিপুল পাঠকপ্রিয়তা সৃষ্টির মাধ্যমে। ভারতীয় বাংলা গল্প, উপন্যাসে নিমগ্ন পাঠকদের বাংলাদেশি লেখকদের বই পড়তে বাধ্য করেছিলেন তার আশ্চর্য জাদুকরি গল্পের জালে জড়িয়ে। মােহাবিষ্ট পাঠক হুমায়ূন আহমেদের রচনায় মধ্যবিত্ত জীবনের হাসি-কান্নার এমন নিবিড় পরিচয় পেয়েছেন, যেখানে তাদের নিজেদেরই জীবনের ছবি প্রতিবিম্বিত। মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর ১৯৭২ সালে নন্দিত নরকে’ শিরােনামে ঢাকা থেকে বের হয় একটি উপন্যাস। উপন্যাসটি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি বাঙালি মধ্যবিত্ত পাঠকদের মন জয় করে নেয়। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে নতুন এক ধরনের উপন্যাস বলে মনে হয়, কারণ এ ধরনের উপন্যাস তারা আগে কখনও পড়েন নি। নন্দিত নরকে’ বইটি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আহমদ শরীফও বইটির প্রশংসা করে লেখেন, বাংলা সাহিত্যে একজন শক্তিশালী ঔপন্যাসিকের আবির্ভাব ঘটেছে।

 

বৃষ্টি ও চাঁদনী রাত ভীষণ পছন্দের

ভ্রমণ বিষয়ক লেখক ও নির্মাতা শাকুর মজিদ স্মৃতিচারণ করে তার একটি লেখা বলেছেন “নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিন ছিল ২০১২ সালের ২৫ মে। আগের দিন থেকে আমরা হাজির। আমরা মানে বেশি লােক নয়, অন্যপ্রকাশের মাজহার, মাসুম, কমল আর অবসর-এর আলমগীর রহমান। কথা ছিল, রাতের খাবার খেয়ে ফিরে আসব ঢাকায়। কিন্তু সে রাতে হঠাৎ করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি নামছে নুহাশপল্লীর বাঁশঝাড়ে, মাঠে, বাগানে। বৃষ্টি থামলে মেঘের আড়াল থেকে কখনােবা ঝলসানাে চাঁদ। এই জ্যোৎস্না আর বৃষ্টি, তার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের আড্ডা আমাকে ঢাকায় ফিরতে ভুলিয়ে দেয়। বৃষ্টি থামলে আমরা পুকুরপাড়ে চলে আসি। সেখানে দুটি নতুন কটেজ বানানাে হয়েছে। কটেজগুলাের প্রশস্ত বারান্দা দিঘিমুখী। একটির মধ্যে ফ্লোরের ওপর আমরা সবাই বসে পড়ি। শাওন গান করে। হুমায়ূন আহমেদ নানা রকম চুটকি বলেন। আসরের কোথাও কিন্তু মনে হত না যে, মরণব্যাধিকে বুকে চেপে মৃত্যুর প্রহর গােনা একজন মানুষ এভাবে আনন্দে মেতে থাকবেন”।

 

আশ্চর্য এক কথার যাদুকর

সেই যে সদ্য স্বাধীন দেশের পাঠক তার নন্দিত নরকে’ আর শঙ্খনীল কারাগার’ পাঠ করে আবিষ্ট হয়েছিলেন, সেই আবেশ আজও কাটে নি বাংলা ভাষার পাঠকদের। প্রথম দুটি উপন্যাস লেখার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্রের তৎকালীন তরুণ অধ্যাপক পিএইচডি গবেষণার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ায় কিছুকালের বিরতি পড়ে তার লেখালেখিতে। কিন্তু আশির দশকে স্বদেশে ফিরে রহস্য উপন্যাস ‘অমানুষ’ রচনার মধ্য দিয়ে আবার বিপুল পাঠকপ্রিয়তায় নতুন করে অভিষেক ঘটে তার বাংলার পাঠক সমাজে। প্রায় একই সময়ে টেলিভিশন নাটক রচনার মধ্য দিয়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে তার খ্যাতি। বিপুল জনপ্রিয়তায় অভিষিক্ত হয় তার প্রতিটি নাটক, উপন্যাস আর চলচ্চিত্র। তারপর আর তাকে পিছু ফিরে তাকাতে হয় নি। তার প্রতিটি বই মানেই লাখ লাখ কপি বিক্রয়। এক মেলাতেই বহু সংস্করণ। প্রাণঘাতী কর্কট ব্যাধি অকালে কেড়ে নেয় এই অনন্য জননন্দিত সাহিত্যিককে মাত্র ৬৪ বছর বয়সে। জীবনে যেমন তিনি ছিলেন বরণীয়, মৃত্যুর পরও এতটুকু ম্লান হয়নি তার বইয়ের চাহিদা। শুধু দুঃখ এই যে, নতুন করে আর কোনও লেখা পাবে না বাঙালি পাঠক তার কাছ থেকে। দেখা যাবে না তার কোনও নতুন নাটক কিংবা চলচ্চিত্র।

 

হিমু আর মিসির আলীর জনক

হুমায়ূন আহমেদের হিমু আর মিসির আলী সিরিজ এদেশে সাহিত্যে এক নতুন ধারা এবং এ দুটি কালজয়ী চরিত্র তাকে বিশেষভাবে অবিস্মরণীয় করে রাখবে। শুধু হাস্যরস আর নিছক মধ্যবিত্তের হাসি-কান্না ধরা পড়েনি তার কলমে, ধরা পড়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালি সমাজ-জীবনের অনেক বড় ঘটনাও। তার নাটকের টিয়ে পাখির মুখের একটি সংলাপ ‘তুই রাজাকার’ বহু বছর আগে সারাদেশে স্বাধীনতাবিরােধী অপশক্তির প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়েছিল, যা সেই সময়ে ছিল দুঃসাহসিক চারণ।

 

পদচিহ্ন এঁকেছেন সাহিত্যের সকল শাখায়

জীবনের অস্তবেলায় ক্যান্সারের সঙ্গে লড়তে লড়তেই লিখে গেছেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের মর্মস্পর্শী ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস ‘দেয়াল’। দুই শতাধিক গ্রন্থের অমর স্রষ্টা একুশে পদক ও একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী এই কুশলী কথাশিল্পী, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার সাহিত্যের যে শাখায়ই হাত দিয়েছেন, সেখানেই রেখে গেছেন তার অসামান্য মেধার স্বাক্ষর।মৃত্যুর ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও হুমায়ূন আহমেদ এখনও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাসে নিজের প্রতিভার বিস্তার ঘটলেও তার শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে। এরপর নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর। আর তিনি সাহিত্যের যে ক্ষেত্রেই নিজের পদচিহ্ন এঁকেছেন প্রত্যেকটিতেই দেখা পেয়েছেন সাফল্যের।

 

হুমায়ুনের রসবােধ ছিল প্রবল মাত্রার

হুমায়ূনের রসবােধ অবিসংবাদিত। উপন্যাস কি গল্প, সিনেমা কি নাটকে। অট্টহাসি নয়; কিন্তু হাসির রেশ বহুক্ষণ পাঠক কি দর্শককে আক্রান্ত করে রাখা কম শক্তির কাজ নয়। গল্প বলার ধরন, বিষয়ের বৈচিত্র্য, বর্ণনায় পরিমিতিবােধ, নাটকীয় চমক সৃষ্টি, ভিন্নধর্মী চরিত্র নির্মাণ, প্রাঞ্জল ভাষা প্রয়ােগ হুমায়ূন আহমেদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। সংলাপ রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন।

 

কে বলে আজ তুমিনাই

হুমায়ূন আহমেদের শরীরে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে যান। সেখানে ২০১২ সালের জুলাই মাসের ১৬ তারিখ তিনি চলে যান লাইফ সাপাের্টে। সেখান থেকেই ৭ বছর আগে ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২৩ জুলাই নিউ ইয়র্ক থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ। সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের উদ্দেশে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে। সেখানে হাজারাে মানুষের অশ্রু-পুষ্পতে সিক্ত হন তিনি। তাকে সমাহিত করা হয় তার গড়ে তােলা নন্দনকানন নুহাশ পল্লীর লিচুতলায়। সেখানেই চির-ঘুমে শায়িত হয়ে আছেন প্রবাদপ্রতীম কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ।

লেখক,

নামঃ মো.তারেক তানভীর

ঠিকানাঃ আদমদিঘী,জেলাঃ বগুড়া

প্রতিষ্ঠানঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়,প্রাণিবিদ্যা বিভাগ,২য় বর্ষ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link